পাকিস্তানের বেলুচিস্তান অঞ্চলে চার শতাধিক যাত্রী বহনকারী একটি ট্রেনে হামলা চালিয়েছে সশস্ত্র জঙ্গিরা। জিম্মি যাত্রীদের মধ্য থেকে শিশুসহ অন্তত ১০৪ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে।
এসময় নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে হামলাকারী সশস্ত্র গোষ্ঠী বালোচ লিবারেশন আর্মির (বিএলএ) কমপক্ষে ১৬ সদস্য নিহত হয়েছে বলে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে।
এছাড়া ট্রেনটিতে এখনও যেসব যাত্রীরা জিম্মি রয়েছেন তাদের উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
কোয়েটা থেকে পেশোয়ারগামী জাফর এক্সপ্রেস ট্রেনটি মঙ্গলবার বালুচিস্তানের বোলান এলাকায় পৌঁছানোর পর হামলার শিকার হয়।
বিস্ফোরণ ঘটিয়ে রেললাইনের একটি অংশও উড়িয়ে দেয়া হয়। এই হামলার দায় স্বীকার করেছে বালুচ লিবারেশন আর্মি।
হামলার সময় ট্রেনে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর শতাধিক সদস্যসহ কমপক্ষে চারশ’ যাত্রী ছিলেন যাদের বেশিরভাগই হামলাকারীদের হাতে জিম্মি হন।
স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়েছে যে, যাত্রীদের জিম্মি করে বালুচিস্তানের রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দাবি করেছে বালুচ লিবারেশন আর্মির সদস্যরা।
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দাবি মেনে না নেয়া হলে জিম্মিদের হত্যা করারও হুমকি দিয়েছে তারা।
এদিকে, হামলার ঘটনার পর পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গোটা এলাকা ঘিরে ফেলে। এরপর জিম্মি যাত্রীদের উদ্ধারে শুরু হয় বিশেষ অভিযান।
বুধবার সকাল পর্যন্ত পাওয়া খবরে জানা যাচ্ছে যে, অভিযানে শিশুসহ ১০৪ জন যাত্রীকে সশস্ত্র গোষ্ঠীর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে আহত ১৭ জন যাত্রীকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
উদ্ধার অভিযান
হামলাকারীদের হাতে এখনও যেসব যাত্রীরা জিম্মি রয়েছেন, তাদের উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত রেখেছেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।
মঙ্গলবার স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ডনকে বালুচিস্তান সরকারের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, ট্রেন থেকে ‘তীব্র গুলিবর্ষণের’ খবর পাওয়া যাচ্ছে।
স্থানীয় পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন ট্রেনটি এখন “পাহাড়ে ঘেরা একটি সুড়ঙ্গের ঠিক সামনে আটকে রয়েছে”।
হামলার শিকার ট্রেনে যে শতাধিক সেনা সদস্য ভ্রমণ করছিলেন, সামরিক বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সেটি বিবিসিকে নিশ্চিত করেছেন।
পাকিস্তানের সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তালাল চৌধুরী স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়ায় বালুচ লিবারেশন আর্মির সদস্যরা এখন নারী ও শিশুদের ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করছে।
তবে যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে খুব সাবধানতার সঙ্গে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অভিযানে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে এখন পর্যন্ত সশস্ত্র গোষ্ঠীর অন্তত ১৬ সদস্য নিহত হয়েছে।
অন্যদিকে, বেলুচিস্তানের রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবি না মেনে জিম্মি উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রাখলে সরকারকে ‘ভয়াবহ পরিণতি’ ভোগ করতে হবে বলে হুমকি দিয়েছে বালোচ লিবারেশন আর্মির (বিএলএ)।
উল্লেখ্য, বালুচিস্তান পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় প্রদেশ। প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকেও প্রদেশটি সবচেয়ে সমৃদ্ধ। কিন্তু উন্নয়নের ছোঁয়া সেখানে লাগেনি।
সশস্ত্র সংগঠন বালোচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) বালুচিস্তানকে স্বাধীন করার দাবিতে কয়েক দশক ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় পুলিশ স্টেশন, রেললাইন, মহাসড়কসহ সরকারি অসংখ্য স্থাপনায় তাদেরকে প্রায়ই হামলা চালাতে দেখা যায়।
বালোচ লিবারেশন আর্মিকে (বিএলএ) নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে পাকিস্তান সরকার।
এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আরও কয়েকটি পশ্চিমা দেশ বিএলএকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করেছে।
ফিরে আসা যাত্রীরা যা বলছেন
নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষ অভিযানে যে শতাধিক যাত্রী জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে কয়েকজন গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন।
জিম্মি থাকাকালে তাদের ‘ভয়াবহ অভিজ্ঞতা’ হয়েছে বলে বর্ণনা করেছেন কেউ কেউ।
“আমরা যে কীভাবে পালিয়ে এসেছি, সেটা বর্ণনা করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। এই অভিজ্ঞতা ভয়াবহ,” জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার পর বার্তাসংস্থা এএফপিকে বলেন মুহাম্মদ বিলাল।
আরেক যাত্রী আল্লাদিত্তা জানিয়েছেন, শারীরিক অসুস্থতার কথা বিবেচনা করে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
৪৯ বছর বয়সী এই যাত্রী বলছিলেন যে, আক্রমণকারীরা যখন ট্রেনে হামলা চালিয়েছিল তখন যাত্রীরা “আতঙ্কে সিটের নিচে লুকাতে শুরু করেছিলেন”।
কোয়েটার স্থানীয় একজন রেল কর্মকর্তা এর আগে বিবিসিকে জানিয়েছিলেন, ৮০ জন যাত্রীর একটি দল জিম্মিদশা থেকে মুক্ত পেয়েছে। তাদের মধ্যে ১১টি শিশু, ২৬ জন নারী এবং ৪৩ জন পুরুষ রয়েছে।
অন্যদিকে, এখনও যারা হামলাকারীদের হাতে জিম্মি রয়েছেন, তাদের আত্মীয়-স্বজনরা উদ্বেগ-উৎকন্ঠার সঙ্গে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন।
এমনই একজন ব্যক্তি বিবিসিকে জানিয়েছে যে, যার শ্যালক এখনও ট্রেনে জিম্মি রয়েছেন। শ্যালকের ব্যাপারে খোঁজ নিতে অনেক দূর থেকে তিনি ছুটে এসেছেন।
কিন্তু অনেক জায়গায় রাস্তা বন্ধ থাকায় গাড়ি চালিয়ে আসতে তাকে ব্যাপক ঝামেলা পেতে হয়েছে।
জিম্মি যাত্রীদের উদ্বিগ্ন স্বজনরা এখন কোয়েটা রেলওয়ে স্টেশনের কাউন্টার থেকে তাদের প্রিয়জনদের তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।
জিম্মি এক যাত্রীর ছেলে মুহাম্মদ আশরাফ বিবিসি উর্দুকে বলেছেন যে, অনেকক্ষণ চেষ্টার পরও তিনি তার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি।
তার বাবা মঙ্গলবার সকালে কোয়েটা থেকে লাহোরের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন।
জিম্মি আরেক যাত্রীর আত্মীয় ইমরান খান জানিয়েছেন, ছোট বাচ্চাকে নিয়ে তার চাচাতো ভাই কোয়েটা থেকে মুলতান যাচ্ছিলেন। পথে এ ঘটনা ঘটায় তার পরিবারের সবাই এখন খুবই উদ্বিগ্ন।
“কেউ আমাকে বলছে না যে ঠিক কী চলছে বা তারা নিরাপদ কি-না,” বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে বলছিলেন ইমরান খান।
স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা বিবিসিকে জানিয়েছেন যে, ট্রেনটি এখন যেখানে আটকে রয়েছে, সেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক বা ইন্টারনেট কোনোটাই পাওয়া যায় না।
ফলে ট্রেনে আটকে থাকা জিম্মিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান কর্মকর্তারা।