“একটা পলাতক দল দেশ ছেড়ে চলে গেছে বা তাদের নেতৃত্ব চলে গেছে। তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করছে এটাকে (দেশটাকে) আনসেটেল (অস্থিতিশীল) করার জন্য”-এই মন্তব্য অধ্যাপক ইউনূসের।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রায় সাত মাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সংস্কার ও নির্বচন, ছাত্র নেতৃত্বের নতুন দল গঠনসহ রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে কথা বলেছেন বিবিসি বাংলার সঙ্গে। একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি কথা বলেছেন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতির প্রশ্নেও।
প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিবিসি বাংলার সম্পাদক মীর সাব্বির।
বিবিসি বাংলাকে দেয়া প্রধান উপদেষ্টার পুরো সাক্ষাৎকারটি বাংলাদেশ জার্নালের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
বিবিসি বাংলা: বিবিসি বাংলার সাক্ষাৎকারে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি মীর সাব্বির। আজ আমার সাথে রয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস।
প্রধান উপদেষ্টা আপনাকে অনেক ধন্যবাদ বিবিসি বাংলার সাথে সাক্ষাৎকারে যোগ দেয়ার জন্য।
প্রধান উপদেষ্টা: আপনাকেও ধন্যবাদ।
বিবিসি বাংলা: সর্বশেষ যখন আপনার সাথে আমার কথা হচ্ছিলো ঠিক এক বছর আগে, এরমধ্যে একটা বিশাল পরিবর্তন হয়ে গেছে বাংলাদেশে। আপনি তখন একটা গ্রেপ্তার আতঙ্কে ছিলেন, আপনি বলছিলেন গ্রেপ্তার আতঙ্কের কথা। সেখান থেকে আপনি প্রধান উপদেষ্টা হয়েছেন, যার ছয় মাস পার হয়ে গেছে। এই ছয় মাসকে আপনি কীভাবে দেখেন? আপনি যা করতে চেয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তাতে কতটা সফল হয়েছেন?
প্রধান উপদেষ্টা: প্রথমেই একটা সংশোধনী বলি, প্রেপ্তার আতঙ্ক – আমার কাছে কোনো আতঙ্ক ছিল না। একটা সম্ভাবনা ছিল যে আমাকে নিয়ে যাবে। আই ওয়াজ টেকিং ইট ইজি যে নিলে নেবে, আমারতো করার কিছু নাই। যেহেতু আইন-কানুন নাই দেশে, কাজেই তারা যা ইচ্ছা তা করতে পারে। ওরমধ্যে দিয়ে জীবন চলছিলো আমার। সরকার যখন গঠন হলো, আমার কোনো চিন্তা ছিল না, ভাবনা ছিল না যে আমি হঠাৎ করে একটা সরকারের প্রধান হবো, দায়িত্ব পাবো। এবং সেই দেশ এমন দেশ, যেখানে সব তছনছ হয়ে গেছে। কোনো জিনিস আর ঠিকমতো কাজ করছে না। যা কিছু আছে ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে কাজ করতে হবে।
কাজেই আমার প্রথম চেষ্টা ছিল সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে আসল চেহারাটা বের করে আনা। মানুষের দৈনন্দিন জীবন সহজ করে আনা। সেই চেষ্টাটার মধ্যে ছিলাম। তারপর আস্তে আস্তে ভবিষ্যতটা কী হবে, সেটার জন্য চিন্তা করা – কোনদিকে আমরা অগ্রসর হবো।
প্রথম চিন্তা আসলো যে একটা সংস্কার দরকার আমাদের। কারণ যে কারণে এসব ঘটনা ঘটেছে, ফ্যাসিবাদী সরকার চলতে পেরেছে। ১৬ বছর ধরে চলতে পেরেছে, আমরা কিছুই করতে পারি নাই। তিন-তিনটা নির্বাচন হয়ে গেলো, ভোটারের কোনো দেখা নাই। এই যে অসংখ্য রকমের দুর্নীতি এবং ব্যর্থতা, মিসরুল ইত্যাদি – সেখান থেকে আমরা কীভাবে টেনে বের করে আনবো। টেনে বের করে আনতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারগুলো করতে হবে। সেজন্য প্রথমে আমরা ঠিক করলাম…
বিবিসি বাংলা: কতটা টেনে বের করে আনতে পেরেছেন বলে মনে হয় আপনার কাছে?
প্রধান উপদেষ্টা: সংস্কারের বিষয়ে? সংস্কারতো এখনও শুরু করিনি…
বিবিসি বাংলা: না, যে বিষয়ে আপনি বলছিলেন যে যখন প্রধান উপদেষ্টা হলাম তখন এক ধরনের পরিস্থিতি ছিল…
প্রধান উপদেষ্টা: অনেক পরিবর্তন…
বিবিসি বাংলা: কতটা পরিবর্তন? আপনার চোখে কী মনে হয়?
প্রধান উপদেষ্টা: বহু পরিবর্তন। এটা আমি বলবো, যে ধ্বংসাবশেষ থেকে এসেছিলাম, তার নতুন চেহারা আসছে। ভেসে উঠছে যে, আমরা অর্থনীতি সহজ করেছি। দেশ-বিদেশের আস্থা অর্জন করেছি। এটাতো পরিষ্কার- সারা দুনিয়ায় আমরা আস্থা স্থাপন করতে পেরেছি। এটা কেউ প্রশ্ন করতে পারবে না যে আমি অমুক দেশের আস্থা অর্জন করতে পারিনি। যে দেশেই বলুন, তারা আমাদের উপর আস্থা স্থাপন করেছে। শুধু আস্থা স্থাপন করেছে না, বিপুলভাবে করেছে। তারা বলছে আমরা অতীতে যা করি নাই তারচেয়ে বেশি করবো এখন, যেহেতু আমরা দেখছি যে সুন্দরভাবে সরকার চলছে এখন। সেইজন্য তারা বলছে। কাজেই এটা একটাতো বড় প্রমাণ। যখনই আপনি দেশের সারিগুলা দেখবেন- প্রত্যেকটা দেশ নিজে এসে বলেছে, আমরা তোমাদের সমর্থন করছি। তোমাদের যা দরকার আমরা দেবো। অবিশ্বাস্য রকমের সহায়তা দিয়েছে তারা।
বিবিসি বাংলা: বিদেশে আপনি আস্থা এবং সমর্থনের কথা বলছেন, আমি যদি দেশের প্রসঙ্গে আসি- আইনশৃঙ্খলা প্রসঙ্গে আসি। আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে কিন্তু অনেক সমালোচনা হচ্ছে। এবং আমি যদি পুলিশের এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যান দেখি, অপরাধ কিন্তু বেশ কিছুটা বেড়েছে। তো এটা আপনারা কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না?
প্রধান উপদেষ্টা: আস্থার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, আস্থার কথাতেই ফিরে যাই, দেশ-বিদেশের আস্থা। দেশের মানুষের আস্থা আছে কিনা আমদের উপর এটাইতো বড় কথা।
প্রমাণ। আমরা কী করছি না করছি- এগুলো খুচরো বিষয় আছে। আমাদের খুচরো বিষয় এটাতে ভালো, ওটাতে মন্দ- কিছু ভালো, কিছু মন্দ, হতে থাকবে। এটা একটা অপরিচিত জগৎ, আমরা এসেছি। আমরা কোনো এক্সপার্ট এখানে এসে বসি নাই। আমরা এসেছি যার যার জগৎ থেকে এসেছি, নিজের মতো করে চেষ্টা করছি কীভাবে করতে পারি। তারমধ্যে ভুলভ্রান্তি হতে পারে। কিছু ভালো করেছে, কিছু ভালো করতে পারেনি। এটা হতে পারে। এটা আমিতো অস্বীকার করছি না।
বিবিসি বাংলা: ভালো হয়নি কোনটা আপনার চোখে?
প্রধান উপদেষ্টা: কোনোটাই ভালো হয়নি সে অর্থে। যত ইচ্ছা আমদের –আমাদের ইচ্ছাতো অনেক। রাতারাতি দেশ পরিবর্তন করতে চাই। সেটাতো আমরা পারি নাই। সময় লাগবে।
আমরা চেয়েছিলাম যে এখনই আমরা সংলাপটা শুরু করবো। এটাও পারি নাই। সংলাপ শুরু হতে হতেও দেরি হয়ে যাচ্ছে। এগুলা আর কি। যেগুলো সময়মতো আমরা করতে চেয়েছি, ওই সময়ে করতে পারিনি।
আমরা অনেকগুলো সংস্কার কমিশন করেছি। আমাদেরকে ৯০ দিনের মধ্যে কমিশনের রিপোর্ট দেয়ার কথা। তারা দিতে পারে নাই। আমি অভিযোগ করছি না। কারণ বিশাল একটা কাজ। আরেকটু সময় চেয়েছে- এক মাস, দুই মাস। ওইটুকু একটু পিছিয়ে গেছে। এগুলো আর কী। কাজ করতে গেলে যা হয়।
‘অপরাধের পরিমাণ মোটেই বাড়েনি’
বিবিসি বাংলা: সংস্কারের কথা বলছিলেন, আমরা যদি আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে ফিরে আসি, পরিস্থিতির যে অবনতি হয়েছে, অনেকেই বলছেন যে তারা নানা রকম ভয়ে আছেন, আতঙ্কে আছেন – যেহেতু অপরাধটা তারা দেখছেন, রাস্তাঘাটে যেটা হচ্ছে। এটা আপনারা কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না?
প্রধান উপদেষ্টা: অবনতিটা কোন পয়েন্ট থেকে হয়েছে? এটা বলতে হবেতো আমাকে। আপনি বলছেন অবনতি হয়েছে। কোন রেফারেন্স পয়েন্ট থেকে অবনতিটা হয়েছে? সেটা না দিলেতো আমরা বুঝতে পারবো না।
বিবিসি বাংলা: আমি যদি সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানের কথা বলি, গত বছর এই সময় থেকে অপরাধের পরিমাণ রাস্তাঘাটে যেমন…
প্রধান উপদেষ্টা: আমিতো হিসাব নিচ্ছি। অপরাধের পরিমাণ মোটেই বাড়েনি। আগের মতোই হয়েছে।
বিবিসি বাংলা: আমি যদি একটা পরিসংখ্যান আপনাকে দেই, গত ছয় মাসে …
প্রধান উপদেষ্টা: একটা দিয়েতো আর বিচার হবে না; সমস্ত কিছু নিয়ে আসতে হবে।
বিবিসি বাংলা: ছয় মাসে ডাকাতির সংখ্যা ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এটা পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী। সেটা আমি বলছি। হয়তো পরিসংখ্যান বিভিন্ন হতে পারে, কিন্তু এটা আছে এবং হচ্ছে সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এটা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে?
পুলিশ বাহিনী যাকে দিয়ে আমরা কাজ করাচ্ছিলাম, তারা ভয়ে রাস্তায় নামছিল না। দুইদিন আগে তারা এদেরকে গুলি করেছে। কাজেই মানুষ দেখলেই সে ভয় পায়। কাজেই তাকে ঠিক করতে করতেই আমাদের কয়েক মাস চলে গেছে। এখন মোটামুটি ঠিক হয়ে গেছে। এখন আবার নিয়মশৃঙ্খলার দিকে আমরা রওনা হয়েছি। কাজ করতে থাকবো।
বিবিসি বাংলা: সেই অপরাধের পাশাপাশি আরেকটা বিষয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে, যেটাকে মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা বলা হচ্ছে। যেমন গণপিটুনির একটা বিষয় দেখা গেছে। কিছুদিন আগের কথা যদি বলি, ধানমন্ডি ৩২সহ সারাদেশে অনেক ভবনে ভাঙচুর হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘসময় ধরে এগুলো চললেও সরকারের কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন ভূমিকা দেখা যায়নি। তখন কেন তেমন ভূমিকা দেখা গেল না? আপনি পরে এটা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তখন কেন কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি?
প্রধান উপদেষ্টা: সময় নিচ্ছে। তারা প্রস্তুত হয়ে নিয়ে তাদের মানসিকতা থেকে এখনও মুক্ত হতে পারেনি। এটা একটা জিনিস হতে পারে। আরেকটা হলো যে আমরা তাদের বলেছি, যেকোনো পুলিশ স্টেশনে তারা যেকোনো রিপোর্ট করতে পারে। আইনের আশ্রয় নিতে পারে এবং সেটাকে আমরা সহজ করেছি এখন। বলছি তোমরা ইন্টারনেটে দিয়ে দিতে পারো, অনলাইন পেইজ করতে পারো। যাতে মামলা করতে গিয়ে, হয়রানি হয় – বরাবরই বাংলাদেশের যে ঐতিহ্য, থানাতে গেলে যে সমস্ত হয়রানি হয়, সেটা থেকে বাঁচার জন্য যেন অনলাইন করে। সেই অনলাইনের ব্যবস্থা করছে। যা যা আমাদের মনে হয়েছে যে মানুষকে সহজ করা যাবে, তাদের তথ্য আদানপ্রদান সহজ করা যাবে এবং মামলা করা সহজ করা যাবে, ইত্যাদি।